বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, দৃক পিকচার লাইব্রেরী লিমিটেড এবং আড়ং যৌথ উদ্যোগে মসলিন প্রদর্শনী ও মসলিন পুনরুজ্জীবন উৎসব এর অংশ হিসেবে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে দিনব্যপী Revival of Muslin textile in Bangladesh বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী চার পর্বে বিভাজিত সেমিনারটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন। উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন ইউনেস্কোর সি.ই.ও. মিজ বিয়েত্রিচ কালদুন। তিনি মসলিন পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং কৌশল নির্ধারণের বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন। সেমিনারের প্রথম সেশনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া।
তাঁর বক্তব্যে দৃক, জাতীয় জাদুঘর, আড়ং এবং শিল্প মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করার আহবান জানান। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, মসলিন পুনরুজ্জীবনে সকলের যৌথ প্রয়াস যুক্ত হলে অবশ্যই সফল হওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, নকশার ধরণ, ট্রেড মার্ক এগুলো প্যাটেন্ট করা প্রয়োজন। দৃকের প্রধান নির্বাহী জনাব সাইফুল ইসলাম বলেন যে, আমাদের বর্তমান অবস্থা এবং লক্ষ স্থির করে আমাদের কাজ করে যেতে হবে, তাহলেই মসলিন পুনরুজ্জীবন সম্ভব। এখানে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা আমরা কামনা করছি। মূল প্রবন্ধকার মিস রোজমেরী ক্রিল তাঁর প্রবন্ধে মসলিনের ইতিহাস তুলে ধরেন। তাঁর প্রবন্ধে খ্রি:পূ: ছয় হাজার থেকে শুরু করে খ্রিষ্টীয় উনিশ শতক পর্যন্ত মসলিনের ইতিহাস উঠে এসেছে। ড. হামিদা হোসেন বলেন যে, ঢাকা মসলিন উৎপাদনের অন্যতম মূল কেন্দ্র ছিল। মসলিনের সোনালী অতীতকে ধরে রাখতে একটি টেক্সটাইল মিউজিয়াম স্থাপন করা খুবই দরকার। এই মিউজিয়াম থেকে তাঁতীগণ, শিক্ষক/শিক্ষার্থী ও গবেষকগণ নানা ধরণের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে মসলিন পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে কাজ করতে পারবেন। জামদানীর নকশার শুদ্ধতা বজায় রাখার ব্যাপারেও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব জামাল অব্দুল নাসের চৌধুরী বলেন, নোয়াপাড়ায় ৫.৮ একর জায়গায় জামদানী গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। বিসিকের মাধ্যমে জামদানী তাঁতশিল্পীদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সাবেক সিনিয়র সচিব ড.সোহেল আহমেদ বলেন, বিশ্ব-বাজারে মসলিনের চাহিদা জরিপ করা প্রয়োজন। বিশিষ্ট কারুশিল্পবিদ বিবি রাসেল মসলিন এবং জামদানির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে সেটি খেয়াল রাখতে হবে বলে মত দেন। সেমিনারের দ্বিতীয় সেশনের মূল প্রবন্ধ Muslin- Restoring our Heritage. উপস্থাপনা করেন যুক্তরাজ্যের মসলিন ট্রাস্টের রিসার্চ ফেলো ড. সোনিয়া আ্যশমোর। সেমিনারে সভাপতি ও মডেরেটর হিসেবে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী দায়িত্ব পালন করেন। প্যানেলিস্ট হিসেবে ভারতের বিশিষ্ট টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ জনাব রুবি পাল চৌধুরী প্রাচীন বাংলায় মসলিন শিল্পীদের- বিশেষ করে নারী মসলিনতাঁতীদের জীবনকাহিনী এবং সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে ঊনিশ শতকে নির্মিত তাঁতীদের তাঁতশিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক সেমিনারের এক পর্যায়ে আলোচনায় তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, জাতীয় জাদুঘর ভবিষ্যতে মসলিন পুনরুজ্জীবন ও ঐতিহ্যবাহী জামদানী রক্ষায় যৌথভাবে কাজ করে যাবেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দীন আহমেদ বলেন, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেসি সিনহা বাংলার অর্থনৈতিক অবনতির অন্যতম কারণ হিসেবে মসলিন বুনন ও রফতানী বন্ধ হয়ে যাওয়াকে উল্লেখ করেছেন। তৃতীয় সেশনে চেয়ারপার্সন ও মডেরেটরের দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান জনাব নজিবুর রহমান। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. ফরিদ উদ্দিন মূল প্রবন্ধ Manufacturing Muslin-Challenges in Cotton Growing, Spinning and Weaving উপস্থাপন করেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধে বিভিন্ন ধরণের তুলা উৎপাদনের বিষয়ে আলোকপাত করেন। বিশেষ করে ফুটি তুলা উৎপাদনের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত সম্পর্কে ব্যাখা প্রদান করেন। মসলিন বুননে যে ধরণের তুলা ব্যবহার করা হতো সেটি মূল জিন পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। প্যানেলিস্ট হিসেবে কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, দুটি জিনিষ চিন্তা করতে হবে- মসলিনের শুদ্ধতা ও এখনকার বাস্তবতায় পুনরায় সুত কাটনিদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও হাতে তৈরি সুক্ষ সুতা তৈরি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। তিনি আরো বলেন, ইউনেস্কোর অর্থায়নে জামদানি নকশা বই মুদ্রণ করে তা জামদানি তাঁতীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। রম্নপসী গ্রামের বিশিষ্ট জামদানি শিল্পী আবুল কাশেম বলেন, তিনি তাঁর বাবা মায়ের কাছে দাদা-দাদির মসলিন বোনার গল্প শুনেছেন। তিনি পরম্পরার শিল্পী হিসেবে তাঁর বাবা মার কাছ থেকে জামদানি বোনা শিখেছেন। তবে তিনি জানান যে, বর্তমানে জামদানি কারিগররা উপযুক্ত মজুরি না পাওয়ায় জামদানি বুনতে চান না। ভালো মানের সুতা ও কারিগরের অভাবে উন্নতমানের জামদানি তৈরি করা যাচ্ছে না। তবে তিনি ১২০ কাউন্ট থেকে ১০০ কাউনেটর সুতা দিয়ে উন্নমানের জামদানি তৈরি করতে পারবেন। তিনি সরকারের নিকট ভালো মানের সুতা ও মজুরীর বিষয়ে প্রত্যাশা করেন। বিশিষ্ট জামদানি গবেষক মালেকা খান বলেন, ঐতিহ্যবাহী মসলিন ও জামদানি শাড়ী বুননে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী তাঁত শিল্পীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । সেমিনারের চতুর্থ ও সমাপনী সেশনে Marketing Muslin- finding ways of Selling the ‘New Muslin’ মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোলকাতা উইভারস স্টুডিও’র সত্ত্বাধিকারী মিস দর্শন শাহ্। দর্শন শাহ তাঁর প্রবন্ধে বলেন যে, তাঁতশিল্পী ও গবেষকদের জন্য একটি পাবলিক ডোমেন তৈরি করা প্রয়োজন, যেখান থেকে এই শিল্প সম্পর্কে তথ্যাদি তারা পাবেন। সেমিনারে সভাপতিতব ও মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র সচিব জনাব হেদায়েত উলস্নাহ- আল -মামুন এনডিসি। তিনি বলেন যে, জাদুঘর ও দৃক কিভাবে মসলিনের পুনরুজ্জীবনের গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাবে, সে বিষয়ে তারা একত্রে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। প্যানেলিস্ট হিসেবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ন্যাশনাল ক্রাফটস্ কাউন্সিলের সহ সভাপতি জনাব রুবি গজনভী ও আড়ং এর বিপণন প্রধান জনাব তানভীর হোসেন। সেমিনারের শেষ পর্বে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সারা দিনের চারটি পর্বের সেমিনারে উপস্থিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, সরকারী ও বেসরকারি, বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষক, পলিসি-মেকার, কারুশিল্প সংস্থাসমূহের অংশগ্রহণকারীদের ও মিডিয়ার প্রতিনিধিদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান । ভবিষ্যতে মসলিন পুনরুজ্জীবনে সমবেতভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে সেমিনারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।