ঢাকা, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭। ‘‘অক্ষরযোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণকৌশল’’ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণের শুরুতে মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, লেটার প্রেস হারিয়ে গেছে। ভুরুঙ্গামারীতে ১৮ শতকের মধ্য ভাগ থেকে এই লেটার প্রেসটি চালু রয়েছে। সমকালীন সভ্যতাকে ধারণ করার জন্য যে সমস্ত উপাদান এখনো টিকে আছে তার মধ্যে মুদ্রণযন্ত্র একটি। সমকালীন ইতিহাসের এই উপাদানগুলো এখন আমরা জাদুঘরে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে সংগ্রহের চেষ্টা করছি। তিনি সকলকে প্রদর্শনী দেখতে স্বাগত জানান। মূল আলোচনা শুরু করার আগে জাতীয় জাদুঘর নির্মিত তথ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হয়।
এরপর বিশেষ অতিথি হিসেবে মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট আবুল মোমেন বলেন, এই প্রদর্শনীটি লিপির বিকাশ সম্পর্কে তরুণদের ধারণা দেবে । কোলকাতায় যে সীমিত রেনেসাঁ ঘটেছিল তার পেছনে মুদ্রণশিল্পের একটি বড় ভূমিকা ছিলো। বাংলাদেশে ৫০ এর দশক থেকে ৬০ এর দশকে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে, সেখানে মুদ্রণশিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। লেটার প্রেসের সময়কালে একটা সম্মিলিত মানবিক বোধের মধ্যে একটা প্রকাশনা তৈরি হতো। মুদ্রণ এবং গ্রন্থকে কেন্দ্র করেই ‘মানুষের শিল্প’ এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার।
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ড.মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর অত্যন্ত ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। ট্রেডল মেশিন, গেলি, নিউজ প্রিন্ট ভিজিয়ে প্রুফ দেখা এসব কষ্টসাধ্য কাজগুলোর ইতিহাস উত্তরসুরীদের কাছে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। জাতীয় জাদুঘর এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই কষ্টসাধ্য কাজটি করেছে সেজন্য জাদুঘরের সকলকে ধন্যবাদ প্রদান করেন। তবে সব কাজ জাদুঘরের পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, এজন্য তিনি একটি সাংস্কৃতিক জাদুঘর স্থাপনের বিষয়ে মত প্রদান করেন। ড.মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এই প্রদর্শনীটি গ্যালারিতে স্থায়ীভাবে উপস্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান। মুদ্রণশিল্পের পথিকৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। ৬০ এর দশকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী সাবিহ্ উল আলম, শিল্পী হাশেম খান প্রমুখদের প্রসঙ্গও আলোচনায় চলে আসে। ষাটের দশকে একটা প্রজেক্ট তৈরি করে উপাদান সংগ্রহের কাজ শুরু করা যেতে পারে। ষাটের দশকের মানুষগুলো চলে গেলে অনেক উপাদান হারিয়ে যাবে।
বিশিষ্ট লেখক আলী ইমাম আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে লিপির মধ্য দিয়ে। লিপি থেকে অক্ষর এই ভাবে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। লিপি থেকেই মুদ্রণশিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৮৪০ এ বর্ণ পরিচয় ছাপা হলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাগাসারের কল্যাণে। বাংলা টাইপোগ্রাফি দৃঢ়তা পেলো। বাংলা টাইপের সুশোভন রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়েরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি বলেন ।
প্রধান অতিথি সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুদ্রণশিল্পের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। মুদ্রণশিল্প মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাসে একটা বড় ধরনের ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটায়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সংগ্রাম, আন্দোলন ঘটেছে সেক্ষেত্রেও মুদ্রণশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি এই মুদ্রণশিল্প নিয়ে প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য মহাপরিচালককে ধন্যবাদ জানান।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। সে জন্য জাদুঘরে মুদ্রণযন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে এই প্রদর্শনী তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশ সৃষ্টির যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয় তার সাথে মুদ্রণশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা একটি চেতনার জন্ম দেবে। তিনি মুদ্রণশিল্প নিয়ে সরকারি বিজি প্রেসে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন।
‘‘অক্ষরযোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণকৌশল’’ প্রদর্শনীটি জাদুঘরের প্রধান লবিতে আগামী এক মাস জাদুঘরের সময়সূচি অনুযায়ী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের কপি ট্রেডল মেশিনে ছাপিয়ে দর্শকদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে।