ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭। বাংলাদেশের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন শীতলপাটি । বাঙালির গৃহসজ্জা ও দৈনন্দিন গৃহকাজে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক উপাদান। এই লোকশিল্পটি মুর্তা (Schumannianthus dichotomus) গাছের বেতী থেকে বিশেষ বুননকৌশলে শিল্পরুপ ধারণ করে। সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, বরিশাল, ঝালকাঠী, কুমিল্লা, ঢাকা, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনায় এ গাছ প্রচুর পাওয়া গেলেও শীতলপাটির বুননশিল্পদের বেশীরভাগই বৃহত্তর সিলেটের চারটি জেলার (বালাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভী বাজার, সুনামগঞ্জ এবং সিলেট) নীচু এলাকায় বসবাস করে। এখানে বুননশিল্পীরা বংশপরম্পরায় পাটি বুনন কৌশল আয়ত্ব করেছে, সিলেট অঞ্চলের পাটির ঐতিহ্য তাই শতবর্ষী। প্রায় ১০০ গ্রামের চার হাজার পরিবার সরাসরি এই কারুশিল্পের সাথে জড়িত,পাটির বুননশিল্পীরা পাটিয়াল বা পাটিকর নামে পরিচিত।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাটি বুননের কাজ করে থাকেন তবে নারী পাটিবুননশিল্পীরা বুননের কাজে অধিকতর ভূমিকা রাখেন। পুরুষশিল্পী মুর্তা সংগ্রহের পরে পরিবারের সদস্যরা পরিষ্কার করে তা সরু করে কেটে শুকানো,নখানি,দা দিয়ে সরু করে বেতী তোলা, রং করার জন্যে জ্বাল দেয়া,পানিতে শুকানো, রোদে শুকানো প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বুনন উপযোগী করে তোলেন। মুর্তা গাছের বেতীকে বুননের উপযোগী করে তোলা থেকে শুরু করে শীতলপাটি বোনা অবধি প্রতিটি ধাপ পিতা থেকে পুত্র, মাতা থেকে কন্যা পরম্পরায় পারিবারিক শিল্প হিসেবে পরিবাহিত হয়ে আসছে। ব্যবহারের উপর নির্ভর করে শীতল পাটির আকার-আকৃতি ও ডিজাইনের বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই প্রদর্শনীতে বিভিন্ন দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী নানা ধরনের শীতলপাটি উপস্থাপন করা হয়েছে। বুননের মাধ্যমে পাটিতে পাখি, ফুল-লতা-পাতা বা অন্যান্য জ্যামিতিক নকশা,মসজিদ, চাঁদ, তারা, পৌরাণিক কাহিনীচিত্র, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, শাপলা, পদ্ম ও কখনো প্রিয়জনের নাম কবিতা পাটিকে অনন্য মাত্রা দান করে। দর্শকদের সরাসরি পাটি বুননকৌশল দেখানোর জন্য সিলেট থেকে চারজন সুদক্ষ পাটি শিল্পীকে আনা হয়েছে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিকে ইউনেস্কোর Intergovernmental Committee for the Safeguarding of the Intangible Cultural Heritage শীর্ষক অধিবেশনে বিশ্বের নির্বস্ত্তক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (The Intangible Cultural Heritage of Humanity ) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়েছে। স্বীকৃতি পাওয়ার প্রারম্ভে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এ উপলক্ষে আয়োজন করেছে শীতলপাটির বিশেষ প্রদর্শনীর। জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এম.পি. । বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মো. ইব্রাহিম হোসেন খান এবং দেশের বিশিষ্ট লোকশিল্প গবেষক শ্রী চন্দ্রশেখর সাহা । সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান ।
স্বাগত ভাষণে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, শীতলপাটি দেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হস্ত ও কুটির শিল্প হিসেবে এই শিল্পের বিকাশ লাভ হয়েছে। নির্বস্ত্তক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবেও এর গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে শীতলপাটির প্রদর্শনী কমপক্ষে ৯ দিন চলবে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, সিলেটের শীতলপাটির উপর গবেষণার অভাব রয়েছে। জাদুঘর পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে শীতলপাটি উপর ডকুমেন্টেশন প্রস্তুত করবে যার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে।
বিশেষ অতিথি বিশিষ্ট লোকশিল্প গবেষক শ্রী চন্দ্রশেখর সাহা বলেন শীতলপাটির বয়নরীতির ব্যাপারে। প্রয়োজনের তাগিদে আবিস্কার এই শিল্প পৃথিবীর এক বিস্ময় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন এই শিল্পকে সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব বলে তিনি জানান।
প্প্রধান অতিথির ভাষণে সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এম.পি. বলেন, শীতলপাটির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কারুশিল্পের রক্ষায় লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের অব্দান রাখার সুযোগ অনেক বেশি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই শিল্পের সাথে নতুনত্ব এনে তাকে রক্ষা করতে হবে। এখন কারুশিল্পীদের নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে শিল্পীরা তাদের স্বাধীনতা হারাচ্ছে। ইউনেস্কো কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ICH আয়োজিত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিকে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ২০১৭ (The Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত বলে তিনি জানান। আশা করা যায় আগামীকাল এই স্বীকৃতি পেয়ে জামদানি, বাউল গান, মঙ্গল শোভাযাত্রার মত পৃথিবীর কাছে সগৌরবে আত্মপ্রকাশ করবে বাংলাদেশের শীতলপাটি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে বর্তমান সরকার শীতলপাটিকে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার প্রচেষ্টা করে।
সভাপতির ভাষণে শিল্পী হাশেম খান বলেন, দেশের কারুশিল্পীদের রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। শুধু স্বীকৃতি পেলেই হবেনা এই শিল্পের ভবিষ্যত ও নিশ্চিত করতে হবে।