বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কবি সুফিয়া কামাল-এর স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন।

ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা কবি ও নারী জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামাল-এর স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক দিল মনোয়ারা মনু। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য অধ্যাপক সোনিয়া নিশাত আমিন।

 

আলোচনায় বিশিষ্ট সাংবাদিক দিল মনোয়ারা মনু বলেন, সুফিয়া কামাল ছিলেন একাধারে কবি, বুদ্ধিজীবী, সমাজনেত্রী। যে সময়ে মুসলিম মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল একেবারেই পশ্চাৎপদ, সে সময়ে সুফিয়া কামালের মতো স্বশিক্ষিত ও সমাজপ্রগতি-সচেতন নারীর আবির্ভাব ছিল এক অসাধারণ ব্যাপার। শায়েস্তাবাদে নানার বাড়ির রক্ষণশীল অভিজাত পরিবেশে বড় হলেও সুফিয়া কামালের মনোগঠনে দেশ, দেশের মানুষ ও সমাজ এবং ভাষা ও সংস্কৃতি মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সুফিয়া কামাল তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। বাড়িতে উর্দুভাষার চল থাকলেও নিজ উদ্যোগেই বাংলা ভাষা শিখে নেন এই মহীয়সী নারী।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ১৯১৮ সালে কলকাতায় কবি সুফিয়া কামাল এর পরিচয় হয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর সাথে। তাঁর শিশু মনে রোকেয়া-দর্শনের সেই স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকে; রোকেয়ার ব্যক্তিত্ব তাঁকে অবিরাম অনুপ্রাণিত করতে থাকে। ১৯২৯ সালে সুফিয়া কামাল বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত মুসলিম মহিলা সংগঠন ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’-এ যোগ দেন। এখানে নারীশিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারসহ নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। বেগম রোকেয়ার সামাজিক আদর্শ সুফিয়াকে আজীবন প্রভাবিত করেছে। তিনি রোকেয়ার ওপর অনেক কবিতা রচনা করেন এবং তাঁর নামে মৃত্তিকার ঘ্রাণ (১৯৭০) শীর্ষক একটি সঙ্কলন উৎসর্গ করেন। তিনি ‘রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি’ গঠনে সহায়তা করেন, যার প্রস্তাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হল ‘রোকেয়া’ তাঁর নামে করা হয়। ১৯৩১ সালে সুফিয়া মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর সদস্য নির্বাচিত হন বলেও তিনি জানান।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় কবির সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটি। এর ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এর মাধ্যমেই সুফিয়ার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে, তখন দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যের ক্ষেত্রে সুফিয়া সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ এ একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলার ব্যাপারে সাহায্য করেন। পরের বছর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশ করলে তিনি তার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন।

প্রধান অতিথির ভাষণে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন কবি সুফিয়া কামাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতঃপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন।

সভাপতির ভাষণে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য অধ্যাপক সোনিয়া নিশাত আমিন বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই সংগ্রামী নারী উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, এই সাহসী নারী শুধু নিজেই আজীবন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন তা কিন্তু নয় তিনি নারীদের দেখিয়েছেন কীভাবে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন এবং ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। সুফিয়া, তাঁর স্বামী ও ছেলে দেশের মধ্যেই থেকে যান মুক্তিবাহিনীকে সাহস ও শক্তি জোগানোর জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবরা-খবর সরবরাহের জন্য। সুফিয়া কামালের প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ নারী অধিকার আদায়ের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। তিনি তাঁর কাব্যপ্রতিভা ও কর্মের গুণে ‘আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন’ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

Contact Us:

Phone (PABX): +88-02-58614842, +88-02-58614880, 58615012-3
Fax: +88-02-9667381
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
Web: www.bangladeshmuseum.gov.bd