বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে লেখক ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজন।

ঢাকা, ২১ জানুয়ারি ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিকেল ৩টায় কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান লেখক ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ এর স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে । অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য প্রদান করেন লেখক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী ।

অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, লেখক যেভাবে তাঁর গবেষণাগুলো করতেন তা ছিল খুবই সুন্দর । সম্পাদনায়ও ছিলেন অতুলনীয়। তাঁকে হারানোর পর বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা আসলে অপূরণীয়। দায়িত্বশীলতার সাথে গবেষণা করার ব্যাপারে তিনি অনুকরণীয় আদর্শ।

অনুষ্ঠানে মূল বক্তেব্যে লেখক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত বলেন, কবি হিসেবে তিনি ছিলেন এদেশের একজন শীর্ষ কবি। গবেষণা ও সমালোচনাকে এমন এক পর্যায়ে পৌছে দিয়েছেন যা আর কেউ পারেননি। তাঁর গবেষণা সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসাকে উস্কে দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রধান পরিচয় জীবনানন্দ গবেষক হিসেবে হলেও তিনি নজরুলের উপরেও গবেষণা করেন। যেকোনো লেখার মধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। প্রচণ্ড তোলপাড় করা শক্তি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। বাংলা কবিতায় তিনি যুক্ত করেছিলেন পরাবাস্তববাদী দিগন্ত। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি তাঁর ভাষাকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমী। পরর্তীকালে দুই বাংলাতেই তাঁর মতো সাহিত্যসমালোচক খুঁজে পাওয়া বিরল। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে ছিল তাঁর অগাধ ধারণা। সমসাময়িককালে তাঁর মতো বড় মাপের লেখক দেখা যায় না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও কবিতায় তাঁর সৃজনশীলতা অসাধারণ। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করলেও ভগ্নস্বাস্থ্য উপেক্ষা করে তিনি আরো কাজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "মাইকেল সম্পর্কে, বঙ্কিমের উপন্যাস সম্পর্কে আমার লেখার ইচ্ছা আছে। ফররুখ আহমেদ একজন বিরাট লেখক। আমার একটা আক্ষেপ, এত বড় কবি জসীমউদদীন, তাঁর ওপর আমি কোনো কাজ করিনি। জীবনানন্দকে নিয়ে আমি যে কাজটা করেছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও সে রকম কাজ করা আমার উচিত ছিল। তাঁর আত্মজৈবনিক লেখার মধ্যে বিষাদের সুর পরিলক্ষিত হয়। যে তুলনারহিত সৃজনশক্তির স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তার মূল্য জীবদ্দশায় যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি। স্বীয় বিশ্বাসে রাজনৈতিক উদারতা ধারণের কারণে তাঁকে প্রায়শ: রাষ্ট্রীয় উপেক্ষার শিকার হতে হয়েছে। তাঁকে স্কলার-ইন-রেসিডেন্স পদমর্যাদায় নিয়োগ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামী জীবনকে গ্রোথিত করে পূর্ণাঙ্গ নজরুলজীবনী রচনার দায়িত্ব দেয়া হয়।

অনুষ্ঠানে আলোচক বিশিষ্ট কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী “স্বপ্নময় উৎসব” শীর্ষক রচনা পাঠ করেন। এতে প্রারম্ভিক কালে আবদুল মান্নান সৈয়দের জীবনী জানতে পারা যায় তার প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ, যার মাধ্যমে তিনি নতুন ভাবে কবিতাকে পাঠকের সামনে আনেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার লেখা বিভিন্ন কবিতায়। তাঁর বহুল আলোচিত দুটি উপন্যাস হলো ‘পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী’ ‘অ-তে অজগর’। তাঁর গল্প-উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রাধান্য পেয়েছে। বলা হয়েছে, "ষাট দশকের গল্পকারদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ সবচেয়ে বেশি প্রাতিস্বিকতাবিলাসী শিল্পী। আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার গল্পভাষ্য নির্মাণে তিনি সিদ্ধহস্ত। বিষয়াংশ এবং প্রকরণের অভিনবত্বে তাঁর গল্পসাহিত্য বিশিষ্টতার দাবিদার। তবে, প্রথম পর্বের গল্পে, কনটেন্ট ও ফর্মে, আরোপিত উপাদান গল্পের মূলস্রোতের সঙ্গে জৈবসমগ্রতায় একাত্ম হতে পারেনি। বিচ্ছিন্নতা ও নির্বেদের যন্ত্রণায় তাঁর অধিকাংশ নায়ক পীড়িত ও পর্যুদস্ত। প্রথম পর্বের গল্পের ভাষারীতিতে আরোপিত আধুনিকতা দ্বিতীয় পর্বে পরিত্যক্ত হয়েছে; ফলে, গল্পস্রোত হয়েছে অনেক বেশি সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ।" লেখক ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রারম্ভিককালের রচনা নিয়ে সমৃদ্ধ আলোচনা করে এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের বক্তব্যের সঙ্গে নিজের বক্তব্যের মিল খুঁজে পান।

অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করেন এবং তিনি জানান আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করতেন। বাঙালি সংস্কৃতির একটি সমস্যা হচ্ছে নিজেদের মুসলমান পরিচয় দিতে আমাদের মনে একটি সংকোচবোধ হয় যা আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর চোখে পড়ে। আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখায় পরাবাস্তব যেভাবে এসেছে সেভাবে আর কারো লেখায় আসেনি। চেতনার ভাবনায় তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। কথার ফাঁকে কৌতুক করা ছিল তাঁর সুনিপুণ অভ্যাস। স্বভাবে বিজনবাসী হলেও তিনি ছিলেন আড্ডার ভক্ত তবে পড়াশুনা আর লেখালেখির ব্যাপারে এক মুহূর্ত ছাড় দেননি। এ বিষয়ে তিনি সদা উন্নীদ্র, আমৃত্যু চঞ্চল। রাষ্ট্র ও সমাজ তার যথাযোগ্য মূল্যায়ন করতে পারেনি বলে একটি সূক্ষ্ম অভিমান তাঁকে তাড়া ক'রে ফিরতো। দু'বার হার্ট এটাক তার জীবনী শক্তি অনেকখানি খেয়ে ফেলেছিল। তাঁর অস্তিত্বে সেঁটে গিয়েছিল এক অনপনেয় বিষণ্ণতা।একটি কবিতায় তিনি মৃদু কণ্ঠে বলেছেন: আনন্দ কাকে বলে আজ আর মনে নেই আমার।তবে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন একজন জীবিত মানুষ। তাই জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে জীবন দর্শনের পুনর্মূল্যায়ন করে বলেছিলেন, "একটা বয়সে এসে বুঝতে পারছি, আমি চারপাশে তাকাইনি। দ্বিতীয়বার হৃদরোগের পরে, দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থেকে আমি আমার আশপাশে মানুষদের দেখলাম- আমার পাড়ার মানুষেরা, বাজারের লোকজন, খুব সাধারণ মানুষদের। বুঝতে পারছি, যাদের দিয়ে আমার জীবন চলছে, তাদের জন্য আমি কোনো কিছু করিনি।মান্নান সৈয়দ ছিলেন সাহিত্যের ঘোর লাগা মানুষ। তিনি আপাদমস্তক একজন কবি, সাহিত্যকর্মী।

Contact Us:

Phone (PABX): +88-02-58614842, +88-02-58614880, 58615012-3
Fax: +88-02-9667381
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
Web: www.bangladeshmuseum.gov.bd