ঢাকা, ০৪ মার্চ ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে বিকেল ৩টায় কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘নবাব স্যার সলিমুল্লাহ: জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয় । সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী । সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ । আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাবেক কীপার ও গবেষক ড. মো. আলমগীর এবং বিশিষ্ট গবেষক জনাব অনুপম হায়াত। সভাপতিত্ব করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব জনাব আলী ইমাম মজুমদার।
সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপনে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বাংলাদেশে এই মহান ব্যক্তিকে স্মরণ করা হয় না । বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর নবাব সলিমুল্লাহর উপর এই অনুষ্ঠান আয়োজন করায় তিনি জাদুঘরকে সাধুবাদ জানান । পরে তিনি জানান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলা দখল করেছিল। এরপর অর্থনৈতিক শোষণ করে সমৃদ্ধ মুসলমানদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে। ১০০ বছর পর ১৮৫৭ সালে দেশীয় কিছু গোষ্ঠীর সহযোগিতা নিয়ে ভারতের শেষ স্বাধীন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে এই কোম্পানি গোটা ভারত দখল করে নেয়। ১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে শাসনভার গ্রহণ করে ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের ওপর ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ঢাকার নবাব খাজা আব্দুল গণির পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করার পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ৩০ বছর বয়সী সলিমুল্লাহ নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। বাস্তববাদী এই তরুণ যথার্থভাবে উপলব্ধি করেন যে, বাংলার পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষায় উন্নতি না হলে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসবে না। তাই তিনি মুসলমানদের শিক্ষাবিস্তারে মনোযোগী হন বিশেষভাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজে বিভিন্ন পেশার লোক বাস করে এবং প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য ও কর্ম স্বতন্ত্র। সুতরাং তাদের শিক্ষাব্যবস্থাও ভিন্ন হওয়া জরুরি । এ জন্য শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে সমাজের লোকদের তিনি চার ভাগে বিভক্ত করেন: ১. অভিজাত বা জমিদার, ২. ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবী, ৩. কারিগর এবং ৪. কৃষক। তিনি এই চার শ্রেণীর পেশা ও দায়িত্বের নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব শ্রেণির জন্য উপযোগী স্বতন্ত্র ধরনের বইপত্র রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সেমিনারে আলোচক ড. মো. আলমগীর বলেন, পূর্ব বাংলার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ভূমিকা নেয়া নবাব স্যার সলিমুল্লাহ'র জীবনের অনন্য কীর্তি ও অবিস্মরণীয় অবদান। ঢাকার নবাব হিসাবে তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল মহল্লায় মহল্লায় নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন। এ থেকেই বোঝা যায় যে তিনি শিক্ষা বিস্তারে কতটা মনোযোগী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজে বিভিন্ন পেশার লোক বাস করে এবং প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য ও কর্ম স্বতন্ত্র। সুতরাং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ভিন্ন ভিন্ন হওয়া জরুরী।
সেমিনারে আলোচক জনাব অনুপম হায়াত বলেন, নবাব সলিমুল্লাহ সব সময় ছিলেন অবহেলিত মুসলমানদের পাশে। তিনি ছিলেন ইংরেজদের অত্যাচারের সময় মুসলমানদের একমাত্র মুখপত্র। তিনি ছিলেন মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে আজীবন সচেষ্ট। তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ফলেই ১৯০৫ সালে বঙ্গদেশকে দুই ভাগে ভাগ করে, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও আসাম নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ গঠন করেন।
প্রধান অতিথি কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, বাঙ্গালী মুসলমানরা আজো আইডেনটিটি ক্রাইসিসে আছে । আমরা কখনো আমাদের দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের যথার্থ মর্যাদা দিতে পারিনি । তিনি অনুরোধ জানান যেন নবাব সলিমুল্লাহ’র উপর তথ্যচিত্র দ্রুত তৈরি করা হয় । তাঁর রেখে যাওয়া দৃষ্টান্ত অবলম্বন করে আমাদের অবস্থান খুঁজে পেতে হবে ।
সভাপতির ভাষণে জনাব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নবাব সলিমুল্লাহকে নিয়ে যে কাজ চলছে তা কিছু আশার সঞ্চার করে মনে যে এখনো তাঁকে নিয়ে কাজ বন্ধ হয়নি । বঙ্গবন্ধু, শেরেবাংলা এ. কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাষানীও হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর নামে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছিলেন । আমাদের তাঁকে অনুসরণ করে এসকল ব্যক্তিকে মনে রাখতে হবে । নবাব সলিমুল্লাহ এদেশের এক অনবদ্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং ইতিহাস নবাব সলিমুল্লাহকে সৃষ্টি করেছে আজকের এই বাংলাদেশের ।