ঢাকা, ০৪ জুলাই ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিকেল ৫:৩০ মিনিটে জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এক নারীর সংগ্রামী জীবনের নাট্যরূপ ‘লাল জমিন’ নাটক প্রদর্শন করেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় মান্নান হীরার রচনা ও সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় এতে একক অভিনয় করেন মোমেনা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এমপি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এমপি বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ে গবেষণা পর্যায়ে কিছুটা কাজ হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষিতজন এবং নিরক্ষর অধিকাংশ মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে প্রচার পায়নি। নারীযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গুটিকয় নারী। যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে নারীর ধর্ষণের ঘটনা প্রচার লাভ করেছে অনেক বেশি। যে কারণে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষিতরা অবলীলায় বলে যান, ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা...। প্রকৃতপক্ষে নারীরা মুক্তিযুদ্ধে অনেক বড় সহায়ক শক্তি ছিল। নারী সক্রিয় ছিল কখনও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনোবা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে। যেভাবেই হোক, মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের বিশ্বাস ছিল অবিচল, সাহস ছিল কঠিন। তারামন বিবির মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও অসংখ্য। অজানা-অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন বহু নারী নিজের শ্রম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। অনাহারী, অর্ধাহারী ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনও মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনোবা বোনের মতো। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। যেমন কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা প্রমুখ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। জানা যায়, নারীযোদ্ধাদের জন্য অনুরূপ আরও তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। ‘গোবরা ক্যাম্পে’ মেয়েদের দেয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং : ১. সিভিল ডিফেন্স, ২. নার্সিং, ৩. অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। এই মহীয়সী নারীদের অবদান কখনও ভুলার নয়। এই নাটক তাদের অবদানের উপর ছোট একটি আলোকপাতের চেষ্টা।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারী অংশগ্রহণ করেছিল জীবনবাজি রেখে। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদান সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারীর ভূমিকা কেবল নির্যাতনের শিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় না আনার একটি কারণ, এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল নিম্নবর্গের নারীরা। নারীর ইতিহাস সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পর।
২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে ‘লাল জমিন’ নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ দেশে এবং বিদেশে নাটকটির মঞ্চায়ন প্রশংসিত হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজেও নাটকটির প্রদর্শনী শিক্ষার্থীদের মাঝে সাড়া জাগিয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের সময় চৌদ্দ ছুঁই-ছুঁই এক কিশোরীকে নিয়ে নাটকের গল্প। তার মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধ নিয়ে এগিয়ে চলে কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরীর জীবনে ঘটে গেছে ভয়ানক সব ঘটনা। কিশোরীর ধবধবে জমিন নয় মাসে কী করে একটা ‘লাল জমিন’ হয়ে উঠল, তা নিয়েই এই নাটক। নাটকটি মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখেন। এই নাটক দেখার সময় অনেকের চোখে পানি দেখতে পাওয়া যায়।