ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিকেল ৩টায় বাংলা গানের কিংবদন্তী গায়ক আব্দুল আলীম এর স্মরণে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি-গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন এবং শিল্পীপুত্র ও লোকশিল্পী আজগর আলীম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জনাব মফিদুল হক।
অনুষ্ঠানে আলোচক শিল্পীপুত্র ও লোকশিল্পী আজগর আলীম বলেন, দেশভাগের পর আবদুল আলীম ঢাকা এসে বেতার-শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন। এখানে বেদারউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাইলাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখের নিকট তিনি লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ঢাকার সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় লোকগীতি বিভাগে তিনি কিছুদিন অধ্যাপনাও করেন। বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ইত্যাদি মাধ্যমে গান গেয়ে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি আব্দূল আলীম এর কিছু গান পরিবেশন করেন। কলকাতা, বার্মা, চীন ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করে তিনি বিদেশীদের নিকট বাংলা লোকসঙ্গীতের পরিচয় তুলে ধরেন। আবদুল আলীম মারফতি-মুর্শিদি গানে ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর দরদভরা কণ্ঠে মরমিধারার এ গান অতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠত। তাঁর গাওয়া হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে? গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার একুশে পদক (মরণোত্তর, ১৯৭৭), পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার লাভ করেন।
অনুষ্ঠানে আরেক আলোচক তাসমিমা হোসেন বলেন, অল্প বয়স হতেই বাংলার লোকসঙ্গীতের এই অমর শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো "তোর মোস্তফাকে দে না মাগো" এবং "আফতাব আলী বসলো পথে"। এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোকসঙ্গীতের এক অবিসংবাদিত-কিংবদন্তি পুরুষ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান বলেন, বাংলা লোকসঙ্গীতের এই অমর শিল্পী লোকসঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে জীবন জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল। বাল্যকাল থেকেই আব্দুল আলীম সঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোনো শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। তিনি অন্যের গাওয়া গান শুনে গান শিখতেন; আর বিভিন্ন পালা-পার্বণে সেগুলো গাইতেন। এভাবে পালা-পার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে জনাব মফিদুল হক বলেন, আব্দুল আলীমের কণ্ঠ উপযোগী গান রচনা করছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, কবি আজিজুর রহমান, আবদুল লতিফ, খান আতাউর রহমান, ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান, কানাইলাল শীল, সিরাজুল ইসলাম, শমশের আলীসহ অনেকে। আব্দুল আলীমের গানের সংখা প্রায় ৫০০ হবে। তাঁর গানে বিরহ-বেদনা-বিচ্ছেদ ফিরে ফিরে এসেছে। প্রেমে, প্রকৃতিতে, ভক্তিতে সংগীতের মাধ্যমে এক অনির্বচনীয় লোকের সন্ধান দিয়েছেন তিনি। দরদভরা মায়াময় সুরের আহ্বানে জীবন ও মৃত্যুকে তিনি নিঃসংশয় করতে শিখিয়েছেন। আমাদের শ্রবণ ও মনকে তিনি প্রশান্ত করে গেছেন। তিনি আমাদের স্বদেশকে স্বজন করেছেন। নিজস্ব গায়কি ও সুর-মাধুর্যের গুণে আব্দুল আলীম ছিলেন একজন অনন্যসাধারণ শিল্পী।