ঢাকা, ৩ জানুয়ারি ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিকেল ৩টায় কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম সেরা পণ্ডিত ও মনীষী ডক্টর আহমদ শরীফ স্মরণে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। সেমিনারে ডক্টর আহমদ শরীফ: মনীষা শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক আহমদ কবির। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম। সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে অধ্যাপক আহমদ কবির বলেন, ডক্টর আহমদ শরীফ ১৯৪৪ সালে দুশ পঞ্চাশ টাকার বেতনে গ্রিভেন্সিভ অফিসার হিসেবে দুর্নীতি দমন বিভাগে চাকরি দিয়ে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। আসলে তার রক্তের শিরায় প্রবাহিত ছিল শিক্ষকতার নেশা, ফলে তিনি ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস হতে ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লাকসামের পশ্চিম গাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে অধ্যাপনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে যোগ দেন তবে চাকরির শর্ত ছিল এই যে, তিনি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের বিশাল পুঁথির সম্ভার বিনা অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দিবেন এবং তার বিনিময়ে ঐ পুঁথি দেখভালের জন্য তাঁকে নিয়োগ করা হবে।এই শর্তের সূত্রেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ছাড়পত্র লাভ করেন। ১৯৫২ হতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে বাংলা বিভাগের অস্থায়ী লেকচারার এবং ১৯৫৭ সালে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।১৯৬২ সাল হতে তিনি সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপকও ছিলেন।১৯৬৯ সালে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর চূড়ান্তভাবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদ’-এ যোগ দেন এবং ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ঐ পদে কর্মরত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে আলোচক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, দেশ-কাল-সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথাগত সংস্কার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবসময় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তিসহ সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আগ্রহ। ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মাকর্সবাদের যৌগিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণে, বক্তব্যে ও লেখনীতে। তার রচিত একশ’রও অধিক গ্রন্থের প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত জোড়াল যুক্তি দিয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস ও সংস্কার এবং আন্তরিকভাবে আশা পোষণ করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য। পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশকের শেষ অবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র লিখেছেন।
অনুষ্ঠানে আরেক আলোচক অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, বাংলাদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে ড. আহমদ শরীফ-ই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি সবার কাছে প্রিয় হওয়ার দুর্বলতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলেন। তিনি ১৯৫০-এর শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দিয়ে একটানা ৩৪ বছর অধ্যাপনা করে ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে ড. আহমদ শরীফ একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাকে উপেক্ষা করা যায় তবে কোন অবস্থাতেই তার বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না । দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে মৃত্যুর পরবর্তী বছর অবধি প্রতি বছর গড়ে দুটো করে ড. আহমদ শরীফের মৌলিক রচনা সংবলিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার রচিত সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর শতের অধিক মননশীল গ্রন্থ শুধু অপঠিতই নয়, অগোচরেও থেকে গেছে। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, তার রচিত ও প্রকাশিত মৌলিক রচনার মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা হচ্ছে ১৩ হাজার ৮৪৪ ।
অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, আহমদ শরীফ বড় হয়ে উঠেছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দুর্লভ অমূল্য পুঁথির ভাণ্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সম্ভারের মধ্যে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি ব্যয় করেছেন মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য। যা ইতিহাসের অন্যতম দলিল। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তিসমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজে ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাঁথা হয়ে থাকবে।