ঢাকা, ১৯ মার্চ ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত এবং পুলক চন্দ সম্পাদিত পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতা সংগ্রহ-১ম খণ্ড ও ২য় খণ্ড এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব রাশেদ খান মেনন এমপি। সম্মানিত অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক-গবেষক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান এবং বিশিষ্ট আলোকচিত্রী জনাব নাসির আলী মামুন। সভাপতিত্ব করেন ছায়ানটের সভাপতি অধ্যাপক ড. সন্জীদা খাতুন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক-গবেষক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, গত ১৪ মার্চ ২০১৮ তারিখে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এর স্মরণ সভার আয়োজন করা হয় এবং এর ৫ দিন পর আজ আয়োজন করা হয়েছে পুলক চন্দ সম্পাদিত কবি জসীমউদ্দীনের প্রকাশিত কবিতা সংগ্রহ ১ খন্ড ও ২ খন্ড এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানের। জাদুঘরে গবেষণা কাজের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের । এদেশের স্মরণীয় ব্যক্তিদের স্মরণে জাদুঘরে নিয়মিত সেমিনারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই সেমিনারগুলোতে তাঁদের কীর্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়, জানা যায় তাদের ব্যাপারে অনেক নতুন তথ্যের। এই সেমিনার আয়োজনের পাশাপাশি গবেষণার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বর্তমানে নঁকশী কাঁথার উপর গবেষণা করছে বলেও তিনি জানান।
অতিথির বক্তব্যে তৌফিক-ই ইলাহী বলেন, খুবই জ্ঞানতাপস লোক ছিলেন কবি জসীমউদ্দীন। তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ যা তাঁর বক্তৃতা পড়লে বুঝা যায়। এই সম্পাদনার জন্য পুলক চন্দকে তিনি ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন জাদুঘরে আয়োজিত সেমিনারগুলো জাদুঘরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে, নতুনত্ব আনছে এর কাজে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে জনাব রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় বাংলার রুপ, রসের দেখা পাওয়া যায়। তিনি আরো বলেন সব লেখা সময়কে পাড়ি দিতে পারেনা যা পারত পল্লীকবির লেখা। কবর কবিতা পড়লে বুঝা যায় কত স্পষ্ট করে আবেগ তিনি তুলে ধরেছিলেন এই কবিতায়। তাঁর কবিতা ছিল অসাম্প্রদায়িক। রক্ষণশীল পরিবার থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন কিন্তু শুধু ইসলাম ধর্ম নয় তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে সকল ধর্মের মানুষ ও তাদের উৎসব। তিনি আরো বলেন জসীমউদ্দীন বাংলার অঘোষিত জাতীয় কবি। সবশেষে তিনি পুলক চন্দকে তাঁর কঠোর পরিশ্রমের জন্য ধন্যবাদ জানান।
কবি পুত্র জামাল আনোয়ার বলেন, কবি জসীমউদ্দীন ছিলেন একজন আধুনিক কবি। বেঁচে থাকতে বইয়ের প্রতি এডিশনে তিঁনি পরিবর্তন করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর কবি জসীমউদ্দীনের বইগুলোতে অনেক ভুল রয়েছে। গবেষণার অভাবে এমন হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন পুলক চন্দ সম্পাদিত এই ২ খন্ডের বইগুলো কঠোর পরিশ্রম ও নিবিড় গবেষণার ফসল।
কবিতা সংগ্রহ ২ খন্ডের সম্পাদক পুলক চন্দ বলেন, বহুদিনের শ্রমের ফসল এই ২ খন্ড গ্রন্থ। কবির প্রিয় শহর ঢাকাতে প্রকাশনার সুযোগ পাওয়ায় তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বলেও জানান উপস্থিত দর্শকদের। দুই বাংলায় যদিও কবি জসীমউদ্দীনের বহু বই পাওয়া যায় কিন্তু এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন এই কবিতা সংগ্রহের কবিতা সংকলনে ১৯৭৬ পূর্ববর্তী বইগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া পত্রিকার মধ্যে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে কল্লোল, সওগাত, প্রবাসীসহ বিভিন্ন পত্রিকা। এছাড়াও এই সংকলনের জন্য গবেষণাকালীন পাওয়া গেছে বিভিন্ন বার্তার যার গুরুত্ব ইতিহাসে অসীম। তিনি বলেন এই সংকলন ভবিষ্যতে কবি জসীম উদ্দীনের গবেষণায় অত্যন্ত সহায়ক হবে বলে তিনি আশাবাদী।
অনুষ্ঠানে আলোচক নাসীর আলী মামুন বলেন, মাটি ও মানুষের কবি জসীমউদ্দীন। বাংলায় অনেক বড় কবি এসেছেন কিন্তু মৃত্যুর কিছুদিন পর মানুষ তাদের মনে রাখেননি। কবি জসীমউদ্দীন তাদের থেকে আলাদা মৃত্যুর এতদিন পরও মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে। তাঁর কবিতা এখনো মানুষকে করে বিমোহিত। তিনি আরো বলেন এমন কাব্য সংকলন কলকাতা থেকে উপহার স্বরূপ বাংলাদেশ পেয়েছে। বাংলাদেশের উচিত ছিল এই মহান কবির উপর গবেষণা আরো আগেই করা। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জসীমউদ্দীনের মাঝের সুমধুর সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন উপস্থিত দর্শকদের সামনে। তিনি আরো বলেন গ্রাম বাংলার কথা এত সুন্দরভাবে আর কেউ তুলে ধরতে পারেননি যা পেরেছিলেন কবি জসীমউদ্দীন।
অনুষ্ঠানে আলোচক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, কবি জসীমউদ্দীন বড় হয়েছিলেন কলকাতায় কিন্তু ঢাকায় হয় তাঁর দ্বিতীয় জন্ম। ফোক মিউজিকের প্রতি তিনি আত্মনিয়োগ করেন বলেও তিনি বলেন। তিনি জারি গান নামের একটি বই প্রকাশ করেন । কবি জসীমউদ্দীন ১৯৫১ সালে জানান তিনি দশ হাজার গান সংগ্রহ করেছেন। কবি তিতাস চৌধুরীর সংকলিত একটি বইতে পল্লীকবির লেখা চিঠি প্রকাশিত হয়। তিনি আরো বলেন, যদিও তিনি বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত কবির লেখায় বিদ্রোহী ভাব পাওয়া যায়। ফোক মিউজিকের উপর দেওয়া কবির বক্তব্য পড়ে শুনান তিনি যাতে কবি পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের বর্ণনা খুবই অল্প কথায় কিন্তু অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখা ছিল গুরুচন্ডালী দোষে দোষী কিন্তু এতে শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায় যা প্রকৃত সাহিত্যিকদের লেখায় দেখা যায়।
সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক ড. সন্জীদা খাতুন বলেন, বাংলার এক আশ্চর্য কবি জসীমউদ্দীন। তিনি পুলক চন্দকে ধন্যবাদ জানান তাঁর পরিশ্রমের জন্য। তিনি আরো বলেন জসীম উদ্দীন ছোট বেলা থেকেই কবিগানের প্রতি ছিল দুর্বল। তিলে তিলে তিনি নিজেকে পরিমার্জিত করেছেন। অনেকে বলেন তাঁর লেখায় সাম্প্রদায়িকতার ছাপ রয়েছে কিন্তু কথাটি সম্পূর্ণ ভুল বলে তিনি মনে করেন। জসীমউদ্দীনের লেখনীতে দেখা পাওয়া যায় বাস্তব সত্যের। তিনি বলেন জসীমউদ্দীন পল্লীকবি নয় বরং নাগরিক কবি। তিনি ছিলেন উঁচু মানের প্রতিভাবান একজন কবি। তাকে মানুষ এখনো স্মরণ করে, তিনি আছেন বাংলার মানুষের অন্তরে। পুলক চন্দ ও দে’জ পাবলিশিংকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।