ঢাকা, ০৩ এপ্রিল ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিকেল ৩টায় কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার: জীবন ও কর্ম শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. গওহর রিজভী। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ.কে.এম. শাহনাওয়াজ ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-এর জেনারেল এডুকেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান। সভাপতিত্ব করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জনাব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, উনবিংশ শতাব্দির বাংলার রেনেসাঁ যুগে নতুন চিন্তা মাত্রা যোগ করেন স্যার যদুনাথ সরকার। পূর্ব বাংলার সন্তান হিসেবে বাংলার গর্ব স্যার যদুনাথ সরকার। যদিও বেশির ভাগ ইংরেজিতে লেখা, বাংলায়ও তিনি লিখেছেন কিছু বই যা ধারণা দেয় বাংলার ইতিহাসে এই মহান ব্যক্তির অবদানের ব্যাপারে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এই মহান ব্যক্তিগণের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে জানতে পারা যায় এইসব স্মরণীয় ব্যক্তিদের জীবনী, জানা যায় এই সমাজে তাদের অবদান।
আলোচক অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, পাঁচ বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করেন স্যার যদুনাথ সরকার। পড়াশোনা এবং কর্মজীবন ১৯৮২ সালে পরিপূর্ণভাবে অবসর গ্রহণ করেন। যদুনাথ সরকারের কর্মময় জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। চাকরিজীবন শুরু করেন অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে এবং অধ্যাপক জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে পাটনা ও কটকে। ১৮৯৩ সালে তিনি রিপন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখান থেকে পরে চলে যান মেট্রোপলিটন কলেজে। ১৮৯৮ সালে যোগদান করেন বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল এডুকেশনাল সার্ভিসে। ওই বছরই আবার চলে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে। এক বছরের মাথায় বদলি হয়ে চলে যান পাটনা কলেজে। ১৯১৭ সালে যোগদান করেন কাশী হিন্দু কলেজে। যদুনাথ সরকার ১৯২৩ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তিনি কাশী হিন্দু কলেজে অধ্যাপনা করেন। অবসরের পূর্বে ৫ বছর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন। ১৯২৬ সালের ৪ আগস্ট তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে মনোনীত হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যাপক ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন তিনি। তার পূর্বে কোনো বাঙালি অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন না। এভাবে একবার কলেজ আবার এডুকেশনাল সার্ভিসে চাকরির পর ১৯৩০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। যদুনাথ সরকার তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২৬ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে সিআইই এবং ১৯২৯ সালে নাইট উপাধি প্রদান করেন। (স্যার) খেতাবে সম্মানিত করেন। ১৯৩৬ ও ১৯৪৪ সালে ঢাকা ও পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট উপাধি প্রদান করেন।
আলোচক অধ্যাপক ড. এ.কে.এম. শাহনাওয়াজ বলেন, তিনি গবেষণা করেন মধ্যযুগের উপর। তিনিই প্রথম এই কাজে হাত দেন। কারণ এর পূর্বে এই বিষয়ে কোন ধরনের গবেষণা ছিল না বললেই চলে। এই গবেষণার তথ্য পাওয়া সহজলভ্য ছিল না । প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাস্তবতা বলতে গিয়ে তিনি বলেন সে সময় ধর্মের উপরভিত্তি করে সমাজ গঠিত হয়ে থাকত। সে কারণে এ যুগগুলোকে পাল যুগ, সেন যুগ নামে ভাগ করা হয়েছে। ইতিহাসে সুলতানী যুগের তথ্যসূত্র পাওয়া যাওয়ার কারণে এ সময়কে অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করেন স্যার যদুনাথ সরকার যা মানুষ ভুল বিশ্লেষণও করে থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন বলে জানান। হয়ত তিনি পর্যাপ্ত তথ্যসূত্র পাননি বলে এসময়ের উপর গবেষণায় হাত দেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশিত বাংলার ইতিহাস বইগুলো তাঁর সম্পাদনার ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয় যা এদেশের পরবর্তী ইতিহাস গবেষকদের জন্য আলোকবর্তিকা স্বরুপ।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে অধ্যাপক ড. গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে নিয়মিত এই অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য জাদুঘরের মহাপরিচালককে তিনি ধন্যবাদ জানান। তিনি আরো বলেন এসময়ে এসে জাদুঘরে প্রতিনিয়ত অনেক পরিবর্তন হচ্ছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বর্তমানে যারা ইতিহাস লেখেন তা বুঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু স্যার যদুনাথ সরকার খুব সহজ ভাষায় লিখেছিলেন ইতিহাস। তিনি শুধু মোঘল ইতিহাসই লেখেননি তিনি ইতিহাসকে পুনর্গঠন করেছিলেন। বাংলার ইতিহাসবিদদের মধ্যে তিনিই প্রথম পাণ্ডুরিপি সংগ্রহ তিনি অনুরোধ করেন স্যার যদুনাথ সরকারের উপর ও তার কাজের উপর গবেষণা করার জন্য যা অভাব রয়েছে এখনও যা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।
সভাপতির ভাষণে জনাব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে স্যার যদুনাথ সরকার ও দেশের সকল স্মরণীয় ব্যক্তিদের তুলে ধরতে হবে। নিজেরা ইতিহাস না জানলে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারব না । পশ্চিমা ইতিহাস আমরা পড়ছি কিন্তু নিজেদের ইতিহাস না জানলে আমরা নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারব না । স্যার যদুনাথ সরকার এদেশের ইতিহাসকে সময়ের গর্ভে হারাতে দেননি। এই মহান ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য আমাদের নিজেদের দেশের স্বার্থেই।