ঢাকা, ০৮ আগস্ট ২০১৮। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোকদিবস ২০১৮ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক সেমিনার, জাদুঘরে সংগৃহীত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি-নিদর্শন এবং আলোকচিত্রের মাসব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি। অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে বিকেল ৫:৩০ মিনিটে জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু: কারাগারের রোজনামচা ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সচিব জনাব মো: শওকত নবী বলেন, আগস্ট শোকের মাস। এই মাসে আমরা হারিয়েছি আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। এই মহান নেতার শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর মাসব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও জাদুঘরে সংগৃহীত বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাদুঘরের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরবে।
প্রবন্ধ উপস্থাপনায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, অসমাপ্ত আত্মজীবনী বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাবলি নিয়ে লেখা এবং কারাগারের রোজনামচাতে লেখেছেন ১৯৬৬-১৯৬৮ পর্যন্ত সময়ের কথা। জেলে বসে লেখেন তিনি এসব। বইগুলো পড়লে বুঝতে পারা যায় সর্বদা মানুষের প্রয়োজনের জন্য নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে সাহায্য করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মমর্যাদা ছিল প্রচুর। তিনি মানুষের জন্য আজীবন ত্যাগ করে গেছেন। বর্তমানে আমাদের এখানে এমন নেতৃত্ব দেখা যায় না এখন সকলে নিজের কথা ভাবে মানুষের জন্য ত্যাগে কেউ রাজি নয়। তিনি ছিলেন নিরহঙ্কারী মানুষ। বই থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর লেখায় ফুটে উঠেছে মানুষ হিসেবে ছিলেন তিনি ছিলেন একজন আদর্শ। এদেশের রাজনীতিতে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার আদর্শ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মেনে চলা উচিত।
অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, এই দুটি বইয়ে নানা বিষয়ে লেখা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতি নিয়ে লেখেননি, লিখেছেন শিল্প,সাহিত্য নিয়েও। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি বাঙালি জাতির একটি ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু বইগুলোতে পাগলের ব্যাপারেও বলেছেন তার বইয়ে। বইগুলো পড়লে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন বইপ্রেমী মানুষ। তিনি সময় পেতেন কম কিন্তু জেলখানায় তার সঙ্গী ছিল বই। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেসার উৎসাহে জেলখানায় লেখার কাজটি করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গমাতা জেলখানায় খাতা দিয়ে আসতেন বঙ্গবন্ধুকে এবং পরবর্তীতে সেগুলো সংগ্রহ করে যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে রাখতেন।
আলোচনায় অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বই দুটির ইতিহাস বলতে গিয়ে বলেন, যে খাতাগুলোয় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন সেগুলো ছিল অত্যন্ত সাধারণ। তিনি জানান এই খাতাগুলো থেকে ৫টি বই বের হবে এখন পর্যন্ত ২টি বের হয়েছে। বাকি গুলোর কাজ চলছে। ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধুকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন খাতাগুলোসহ বঙ্গবন্ধুর বাসা দখল করে নেয় পাকিস্তানীরা। পরবর্তীতে যুদ্ধের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ৩২ নম্বরের বাসা হতে খাতাগুলো উদ্ধার করে জানেন। বঙ্গমাতা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করেন খাতাগুলো। প্রথমে ইংরেজিতে প্রকাশিত হলেও তার ভাষা ছিল অনেক কঠিন। পরবর্তীতে সহজ ভাষায় প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। বইটি পাকিস্থানে প্রায় ৪০ হাজারের মত বিক্রয় হয়েছে বলে তিনি জানান। ২য় বইটির নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা। পরবর্তীতে যে বইটি বের হবে তার নাম 'চীন ভ্রমণ' । ৪র্থ বই 'স্মৃতি কথা'র কাজ অর্ধেক হয়ে গেছে। ৫ম বইটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে প্রকাশিত হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন বিস্তারিত ভাবে জেল নিয়ে কেউ লিখেছেন কিনা সন্দেহ আছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রথম পড়ে একজন প্রবাসী মন্তব্য করেছিলেন এই বইটি নিজেরাই রচনা করেছেন যারা এর প্রকাশনার সাথে জড়িত তারাই। তিনি বলেন এই বইয়ের ব্যাপারে মন্তব্য করতে হলে প্রথমে বইটি ভাল করে পড়তে হবে। বইটিতে বঙ্গবন্ধু জেলখানার বিবরণ এত সুন্দরভাবে দিয়েছেন পড়লে মনেই হবে না যে তিনি নিজেও একজন বন্দী, বরং মনে হবে তিনি বাইরে থেকে বসেই রচনা করেছেন। তিনি তাঁর নেতাদের ভুল নিয়ে সমালোচনা করতে আটকাতেন না । তিনি তাদের সরাসরি তার সমালোচনার কথাগুলো জানান। এই বই দুইটিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায় জানা যায় ব্যক্তি শেখ মুজিব কেমন ছিলেন। কেমন ছিল তার ভাবনা ।
সভাপতির ভাষণে শিল্পী হাশেম খান বলেন, আমাদের এই দুইটি বই পড়তে হবে এ কারণে, যে মানুষটির কারণে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাকে জানার জন্য এবং তাঁর দৃষ্টি ভঙ্গি বোঝার জন্য। বইগুলো পড়লে মনে হয় আবার সেই দিনগুলো ফিরে এসেছে। বই দুইটি পড়লে বাংলার মানুষ নিজেদের জানতে পারবে এবং সমৃদ্ধ করতে পারবে নিজেকে। মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। এর পরেই স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির পিতাকে। তিনি থাকলে আমাদের ইতিহাস হয় তো ভিন্ন হতো।