ঢাকা, ১৪ আগস্ট ২০১৮। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোকদিবস ২০১৮ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক সেমিনার, জাদুঘরে সংগৃহীত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি-নিদর্শন এবং আলোকচিত্রের মাসব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি। অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে বিকেল ৪টায় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু: বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শিল্পের বিকাশ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব হাসানুল হক ইনু এমপি। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট লেখক ও জনতা ব্যাংক বোর্ড অব ডিরেক্টরের পরিচালক জনাব আবুল কাসেম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ।
স্বাগত বক্তব্যে জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব আব্দুল মান্নান ইলিয়াস বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিক ও জাতীয় শোকদিবস পালন উপলক্ষ্যে জাদুঘর মাসজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ নিদর্শন নিয়ে মাসব্যাপী বিশেষ প্রদশনীর আয়োজন করেছে।এই প্রদর্শনীতে প্রতিদিন প্রচুর দর্শকের আগমন ঘটে।দেশের মানুষদের মাঝে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা ও তাঁর ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে সঠিক ধারণা জন্মানো এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য।
প্রবন্ধ উপস্থাপনায় জনাব আবুল কাসেম বলেন, প্রাচীনকাল থেকে এদেশের শিল্প ছিল উন্নত। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল শিল্পায়নের দিক থেকে আমাদের সমাজ ছিল অনেক উন্নত। কিন্তু পরাধীনতার কারণে বঙ্গের অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শিল্প ও পরিচালনার নানা কাজে একটি বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নেন যাতে এদেশ শিল্প ও বাণিজ্যের দিক থেকে উন্নতি লাভ করতে থাকে। তিনি বলেন বঙ্গব্ন্ধু অর্থনীতিবিদ ছিলেন না ছিলেন রাজনীতিবিদ। অথচ তিনিই প্রায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এই দুই প্রদেশের জন্য আলাদা অর্থনীতি/মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষে দেশের অবস্থা খারাপ হয়। তিনি সে সময় রাশিয়ার কাছ থেকে বাকিতে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেন। দুর্ভিক্ষ চলাকালীন সময়ে কিসিঞ্চার সাহেব বাংলাদেশে খাদ্যশস্য/রিলিফ পাঠানোর ক্ষেত্রে পুরোপুরি না করে দেন। বঙ্গবন্ধু একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে শিল্প কারখানাসমূহ জাতীয়করণ করেন। ফলে দেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণ উপকৃত হন। একই অধ্যাদেশের মাধ্যমে তিনি ব্যাংকখাতসমূহ জাতীয়করণ করেন। এই উদ্যোগ বিশ্বব্যাপি প্রশংসিত হয়। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী অর্থনৈতিক চিন্তা। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শিল্প কলকারখানা সমূহের ক্ষতি পরিমাণ নিরূপণ করে তা মেরামত ও পুনঃনির্মাণ করার জন্য তিনি নির্দেশনা দেন ১৯৭২-১৯৭৩ সালে। ১৯৭২ সালে পাটসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে যে জোয়ার আসে তা ১৯৭৩ এ স্থিমিত হয়ে যায়। কারণ এ সময় অনেকেই সমাজতন্ত্র ও রাজনীতির ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে যা বাণিজ্যের কাজেকর্মে প্রভাব ফেলে। একইসাথে মিল-কারখানা যেসব অবাঙালি পুরাতন ব্যবস্থাপক ছিলেন তারাও প্রস্থান করেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ব্যাহত হয়। এ সময়ে বাঙালি ব্যবস্থাপক তৈরি হয় নাই। আবার এ সময় বস্ত্রশিল্প সাফল্য মন্ডিত হয়। কেননা এর কাঁচামাল ছিল দেশি। ৭৩-এ তিনি ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করেন যা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। এটি প্রণয়নে ছিলেন সেময়ের পরিকল্পনা কমিশনের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. আতিউর রহমান ১৫ আগস্ট শহীদ ও মুক্তিসংগ্রামে শহীদগণের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ওঠে এলেও সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল যা বড় নেতৃত্বের গুণ। তিনি দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে লঙ্গরখানা খুলে ছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রতি তার ছিল অসীম দরদ যা তার নিজ লেখনী কারাগারের রোজনামচা থেকে জানা যায়। ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির সাধারণ মানুষের মুক্তিবার্তা। যেখানে তার অঙুলির নড়ন, দেহ ভঙ্গী ছিল অর্কেস্ট্রার মতো। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভাষণেই তিনি বলেছিলেন বাংলার মাটি মানুষ নিয়েই সামনে এগিয়ে যাবেন যা ছিল তার অর্থনৈতিক কৌশল। তিনি সংবিধানেও সাম্যভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন করেন। তিনি তার পরিকল্পনাগুলোর পুরো বাস্তবায়ন করতে পারেননি আগস্টের বর্বরদের কারণে। তিনি শারীরিকভাবে চলে গেলেও এদেশের প্রত্যেকের হৃদয়ের মাঝে রয়েছেন। সে সময়ের (৭২-৭৩) এর ৮ বিলিয়ন মুদ্রামানের অর্থনীতি বর্তমানে ২৮০ বিলিয়ন এরও বেশি হবে যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. মইনুল ইসলাম সকল অতিথিবৃন্দকে অভিবাদন জানিয়ে প্রথমেই ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের আত্নার মাগফিরাত কামনা করেন এবং মূল বক্তা আবুল কাসেমের প্রবন্ধের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর যড়যন্ত্র ছিল। ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের সকলে এখনও শাস্তি পায়নি বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশে ১৯৭২-৭৩ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয় নাই তার পুরো কৃতিত্ব ছিল বঙ্গবন্ধু, এই তথ্য মুল বক্তা তাঁর প্রবন্ধে তুলে এনেছেন বলে তাকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তিনি সকলকে সাবধান থাকার আহ্বান জানান এই বলে যে আগস্ট মাস হলো বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত রুখবার মাস। মুলবক্তার প্রবন্ধে উল্লিখিত মেধাবী অর্থনীতিবিদগণ বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে আনার ব্যাপারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লব শুরু হয়। ১৯৭৩-৭৪ এ ধান উৎপাদন ব্যাহত হলেও ৭৪-৭৫ এ রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বিভিন্ন কর্মসূচি/প্রকল্পের মাধ্যমে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সমাজের বৈষম্যের অবসান করতে হবে। যারা কম ভাগ্যবান মানুষ তাদের সাহায্য করতে হবে তবেই সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। ৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু মু্ক্তির কথা বলেন। মাত্র ১০ মাসের মধ্যে তিনি সংবিধান দেন যাতে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ অনেক কিছুর কথা বলা হয়েছে। এ সংবিধানে সমৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে গ্রামে বৈষম্য কমানোর একটি চেষ্টা হয়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সমাজের উন্নয়নে রাষ্ট্র কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে তা বুঝতে হলে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চশমা দিয়ে দেখতে হবে। বর্তমান সরকার সর্বদা পিছিয়ে থাকা মানুষকে টেনে আনার চেষ্টা করেছে বলেই আজ বাংলাদেশ অর্থনীতিতে বিস্ময়কর অগ্রগতি করেছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার অর্থনীতিতে যা উন্নয়ন করছে তার পাটাতন তৈরি করেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সভাপতি ভাষণে জনাব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে এদেশের উন্নয়ন সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে নিয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আমাদের দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে।