ঢাকা, ২৭ আগস্ট ২০১৮। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোকদিবস ২০১৮ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক সেমিনার, জাদুঘরে সংগৃহীত বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি-নিদর্শন এবং আলোকচিত্রের মাসব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি। অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে বিকেল ৩:৩০ মিনিটে জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী বিষয়ক প্রক্রিয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহায়ক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জনাব ওয়ালিউর রহমান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও বিশিষ্ট কলাম লেখক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস।
স্বাগত ভাষণে জাদুঘরের সচিব মো. শওকত নবী বলেন, শূধু একটি ভাল পররাষ্ট্র নীতিই নয় সাফল্যের জন্য এর পেছনে দরকার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তাঁর নেতৃত্ব গুণেই ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল এত সহজে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এত দ্রুত এত সাফল্য অর্জন করেছিল।
জনাব ওয়ালিউর রহমান মূল প্রবন্ধ বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তখন বঙ্গবন্ধু শুধু তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই দেখাননি, তিনি পুরো পৃথিবীকে জানান দিয়েছেন আমরা স্বতন্ত্র বাঙালিয়ানা নিয়ে জন্ম নিয়েছি আমাদের বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। তিনি কূটনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিলেন, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন, তবে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা কিন্তু তিনি ঠিকই দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পুরো পৃথিবীকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি একজন গণতন্ত্রকামী নেতা, এবং তিনি একোমোডেট করলেন আন্তর্জাতিক আইনের আদি লক্ষ্য। এই ভাষণ থেকেই তাঁকে বলা যেতে পারে তিনি একজন চিন্তাশীল দার্শনিক এবং একটি জাতীর স্বপ্নদ্রষ্টা এবং এই ভাষণে তিনি বুঝিয়ে দিলেন হাজার বছরের নিষ্পেষিত বাঙালি জাতির স্থায়ী জাতীয় স্বার্থ কী যা আমাদের পার্মানেন্ট ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট। আমি যখন রিফিউজি হয়ে পুরো ইউরোপে (ইংল্যান্ড ছাড়া) বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চেয়েছি তখন সমস্ত দেশে যেতে ভিসা লাগতো কিন্তু আমার যে রিফিউজি ডকুমেন্ট ছিলো সে ডকুমেন্ট নিয়ে আমি ভিসা ছাড়া ঘুরেছি কোনো অসুবিধা হয়নি। যখন তারা শুনেছে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রিপ্রেজেন্টেটিভ তখনই তারা একটি শব্দ উচ্চারণ করতো, ‘আচ্ছা আপনি যান’ ফরাসি ভাষায় বলতো আলেজি তারা বলতো আপনি শেখ মুজিবের রিপ্রেজেন্টেটিভ আপনার কোনো ভিসা লাগবে না। এ মুজিব স্ফূলিঙ্গ সমস্ত ইউরোপকে আচ্ছন্ন করেছিলো। বঙ্গবন্ধুকে যে অনির্বাচিত স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার অন্যায়ভাবে জেলে আটকে রেখেছে এটা ইউরোপ, জাপান, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলো কখনও মেনে নিতে পারেনি। আজকে যখন আমরা আরব দেশগুলোর দিকে তাকাই আমরা অন্য ছবি দেখি। আরব দেশগুলোর ভেতরে সংঘর্ষ, একাত্মতার অভাব। তবে আমাদের দেশের জন্য কর্মক্ষেত্রে আরব এবং মুসলিম দেশগুলোতে কর্মরত আছেন হাজার হাজার বাংলাদেশী। এ সফলতা এসেছে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতার কারণে।
আলোচনায় জনাব মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর দেয়া প্রথম প্রেস কনফারেন্স-এর ব্যাপারে জানান। তিনি আরো বলেন, ৩৫টি এম্বেসি থেকে ১১৯ জন বাঙালি কর্মকর্তারা চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কূটনীতিক ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলেন, পরাধীন দেশের কোন পররাষ্ট্র নীতি থাকে না। স্বাধীন দেশ পাওয়ার পরই আমাদের দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। এসময় যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের জন্য পররাষ্ট্র নীতিও গঠন করা হয়। স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়ে ভৌগোলিক অবস্থান, স্বল্প পরিসরের ভূখণ্ড এবং সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদ ইত্যাদি বিভিন্ন নিয়ামক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূলত বহিঃশক্তির প্রভাব থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডকে রক্ষা করার মতো বিষয়েই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।এই পর্যায়ে পররাষ্ট্রনীতির যে কার্যক্রম তা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। এই পর্যায়ে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতির প্রভাব স্বাধীনতার পরও পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সময় শূধুমাত্র সৌদি আরব ও চীন ব্যতীত সকল দেশের স্বীকৃতি মেলে বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর সময় যে সাফল্য আমরা দেখতে পেয়েছিলাম এখনো এমন সাফল্য আর দেখা যায় না।
সভাপতির ভাষণে মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস বলেন, রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর পরই ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তিনি পররাষ্ট্রনীতির নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেন, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ঘোষণা করেন: আমরা একটি ছোট রাষ্ট্র, আমাদের সকলের সাথে বন্ধুত্ব হবে এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য তুলে ধরেন, বাংলাদেশ সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে, যার ভিত্তি হবে অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ।